হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সংক্ষিপ্ত জীবনী মুবারক
উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একজন তাবেইন। কারান (Qaran) নামক স্থানের অধিবাসী যা বর্তমানে ইয়েমেনে কোন একটি স্থান। উনার পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বল্য বয়সে উনার পিতা ইন্তেকাল করেন। উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পিতা ও আহলে কিতাব ছিলেন। উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সমসাময়িক কালের ব্যক্তি ছিলেন। যদিও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জীবদ্দশায় নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে উনার ব্যক্তিগত/সরাসরি সাক্ষাৎ হয় নাই তথাপি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে তাবেইন শ্রেষ্ঠ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ পাক উনি হতে প্রেরিত নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখার আন্তরিক আকুলতার খাকার পরও উনার নাম সাহাবী রাদিআল্লাহু আনহুম গন উনাদের তালিকায় স্থান পায়নি যা আমাদের জন্য উদাহরণ স্বরূপ।
উয়ায়েস্ আল–কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনা ইসলাম গ্রহণ:
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অঙ্গুলির নির্দেশ জখন চন্দ্র দু ভাগ হয়ে যায় তখন অনেকে দূর দূরান্ত থেকে নবুওত উনার আলামত প্রকাশ পেয়েছে বলে মদিনা শরীফ গমন করেন। যা সম্পর্কে পূর্ব বর্তী আসমানী কিতাব সমূহে উল্লেখ ছিল। তখন উনার ধর্মের একজন পাদ্রী যিনি পরবর্তী কালে সাহাবী হন উনারা আবার ইয়েমেনে আগমন করেন এবং উনার কাছে বায়াত হয়ে দীন ইসলাম গ্রহণ করেন।
হুজুর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কর্তৃক বর্ণনা:
একদিন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি বলেন “আমি বাস্তবিক আল্লাহ্ তা’আলা উনার রহমতের সুগন্ধযুক্ত হাওয়া ইয়েমেনের দিক থেকে পাচ্ছি।” নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি আরও বলেন “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা সত্তর হাজার ফেরেশতাকে উয়ায়েস্ আল –কারনী অনুরূপ চেহারা দিয়ে সৃষ্টি করবেন।
হাশরের মাঠে উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে তাদের মধ্যে ছুপিয়ে রাখবেন এবং তাদের আড়ালে রেখে উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে বেহেশতেও প্রবেশ করানো হবে। এই বৈশিষ্ট্যের কারণ হল, তিনি দুনিয়াবি জীবনে নিজেকে মানুষের আড়ালে রেখে ইবাদত করতে ভাল বাসতেন, নিজেকে তিনি গোপন রাখার চেষ্টা করতেন যেন উনার ইবাদত বন্দেগীর ধারা দেখে মানুষ তাঁর প্রশংসা এবং গুণ-কীর্তনে লেগে না যেতে পারে। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন তাঁর পার্থিব জীবনের এই চেষ্টা ও অভ্যাসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এবং উনাকে গুরুত্ব দিয়ে রোজ কিয়ামতে উনার জন্য ঐরূপ ব্যবস্থা করবেন।
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি ইসলাম গ্রহণ করেন রাসুলেপাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জীবদ্দশায়, যদিও উনাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই। রাসুলেপাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর তিনি হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনার সাথে উনার সাক্ষাৎ হয়।
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন ” আমার লোকদের মাঝে এমন একজন আছে যে শেষ বিচারের দিনে সকল বিশ্বাসীদেরকে হেফাজতের ক্ষমতা রাখে”. সাহাবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গণ জিজ্ঞাসা করলেন ” কে সেই ব্যক্তি?” নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন “সে আল্লাহর বান্দা।” সাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গণ প্রত্যুত্তরে বল্লেন “আমরা সবাই আল্লার বান্দা। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে পয়দা করেছেন।” সাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গণ প্রশ্ন করলেন ” উনার নাম কি?” নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বল্লেন “উয়ায়েস!” সাহাবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গণ জিজ্ঞাসা করলেন,”তিনি কোথায় থাকেন?” নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন “ইয়েমেন”. সাহাবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গণ জিজ্ঞাসা করলেন, “তিনি যদি আপনাকে ভালোবাসে, তাহলে কেন আপনার খেদমতে হাজির হয় না?” নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবে বল্লেন, “সে আমার পথ গ্রহণ করেছে এবং সে একজন বিশ্বাসীর অন্তর্ভুক্ত; শারীরিক ভাবে তাঁর এখানে উপস্থিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নাই। অধিকন্তু তাঁর পরিস্থিতি তাঁকে এখানে আসতে সহায়তা করে না এবং সে তার অচল-অন্ধ মায়ের সেবা করে। সে দিনের বেলা উট চরায়। সেই আয় থেকে নিজে ও তাঁর মায়ের ভরণ পোষণ করে। সাহাবা রহমতুল্লাহি আলাইহি গন প্রশ্ন করলেন আমরা কি উনাকে দেখতে পাব?” রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,” হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহি সালাম নন, তবে উমর ফারূক্ব আলাইহি সালাম এবং আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনারা পারবে। আপনারা উনাকে পাবেন ইয়েমেনের একটি গ্রাম শারানীতে এবং উনার হাতের তালুতে এবং বুকের পাজরের কাছে সাদা দাগ দেখে আপনারা উনাকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে। যখন আপনাদের সাথে উনার দেখা হবে, উনাকে আমার শুভেচ্ছা দিবে আর আর আমার উম্মতদের জন্য দোআ করতে বলবে।”এটা উল্লেখ্য যে হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাতা ইন্তিকাল এর পরে তিনি হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য বের হন এবং সিফ্ফিনের যুদ্ধে শাহাদাৎ বরন করেন।
জুব্বা/খেরকা মুবারক প্রদানঃ–
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়া থেকে বিছাল শরীফে উনার পূর্বে হযরত নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম এবং হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহি সালাম উনাদের নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার একটি জুব্বা/ খেরকা মুবারক প্রদান করেন এবং জুব্বা /খেরকা মুবারকটি উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি বলেন আমার জুব্বা মোবারকটি উয়ায়েসকে দেবে এবং তোমাদের জন্য এবং আমার সকল উম্মতের মাগফেরাতের জন্য উনাকে দোআ করতে বলবে।”
দাঁত ভাঙ্গার ঘটনা:
ওহুদ উনার জিহাদে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনা দাঁত মুবারক শহিদ হন। আর তৎখনা আল্লাহ্ পাক উনাকে উলহামের মাধ্যমে জানিয়ে দেন। আর তারপর হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ব্যথা অনুভবের মহব্বতে একটি দাঁত ভেঙ্গে ফেলেন। অতঃপর তিনি চিন্তা করেন কোন দাঁত মুবারক শহীদ হয়েছে তা তো উনি জানেন না তাহলে যদি অন্য দাঁত মুবারক হয়? এই ভাবে তিনি এক এক করে সমস্ত দাঁত পাথর দ্বারা ভেঙ্গে ফেলন।
হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে সাক্ষাত লাভের চেষ্টা:
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার দাঁত মুবারক ভেঙ্গে ফেলা এবং মদিনা বশী আসলে তাদের কাছে বেকুল হয়ে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কথা জানতে চাওয়া সব সময় নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি গভীর ভাবে মনোনিবেশ করা উপলব্ধি করে উনার মাতা হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার গৃহে গিয়ে দেখা করার অনুমতি দান করেন। কিন্তু করন (ইয়েমেন) থেকে মদিনা শরীফ অনেক দূর অনেক দিনের রাস্তা প্রায় ৪শ মাইল। একদিকে উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাতা বৃদ্ধ চোখে দেখেন না হাটতে পারেন না আবার অসুস্থ। তাই তিনি উনার প্রতিবেশীদের উনার মায়ের খিদমতে রেখে গেলেন। তিনি সুদীর্ঘ পথ কোথাও মরুময় দিনে চরম গরম বিভ্রান্তিকর কোথাও উঁচু পাহাড় রতে ঠাণ্ডা কিছুকেই তোয়াক্কা করলেন না একটান চললেন মদীনাতুল মনওয়ারায় প্রিয় নবী আহমদ মুসতফা হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দিদারে। এভাবে তিনি মদিনা শরীফ পৌঁছেই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উনার গৃহ মুবারক উনার প্রধান দরজায় এসে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে খোজ করেন। কিন্তু তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি হুজরায় ছিলেন না তবে হযরত যাহরা আলাইহাস সালাম তিনি ভিতর থেকে বলেন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীহাদে গেছেন(যুদ্ধ ময়দানে) সেখান থেকে ফিরবেন। তিনি অপেক্ষা করবেন না চলে যাবেন। উনার তখন মায়ের অসুস্থতার কথা স্মরণে এলো এবং তিনি আবার ইয়েমেনের দিকে রওনা হলেন এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সচক্ষে দেখা হলনা। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি যুদ্ধের ময়দান থেকে এসেই উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কথা জিজ্ঞাসা করেন। এই বিষয়ে মুজাদ্দিদ আল ফেসানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাকতুবাত শরীফে বলেন হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি যদি কিছু সময় অপেক্ষা করে ও যদি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাক্ষাত লাফ করতে পারতেন এবং সোহবত লাভ করতেন তাহলে তিনি সাহবীয়াতের মাকাম হাসিল করতে পারতেন।
সাহাবী আলাইহিমুস সালাম গনের সাথে সাক্ষাত:
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম উনার খেলাফত এর সময় খলীফা ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম উনি এবং হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনাকে সঙ্গে নিয়ে উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি সন্ধানে মদিনা থেকে কুফার গমন করেন। তথায় পৌঁছে উনারা ইয়েমেনবাসীদের কাছে উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি কথা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু তারা কেহই উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সন্ধান দিতে পারল না। অবশেষে এক ব্যক্তি বলল, একটি লোককে তো দেখি সে পাগলের মত প্রায়। সে জনপদে থাকে না। নির্জন এলাকায় তাঁর বসতি, প্রান্তরে উট চড়িয়ে বেড়ায় এবং দিবা শেষে একবার শুকনো রুটি ভক্ষণ করে। তাঁর এক স্বভাব, লোকে যখন হাসে, সে তখন কাঁদে, আর লোকে যখন ক্রন্দন করে সে তখন হাসতে থাকে।
লোকটির কাছে এরূপ খবর পেয়ে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম ও হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনারা কারণ এলাকায় গিয়ে পৌঁছলেন। উনারা যখন উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি কাছে গিয়ে হাজির হলেন, তখন তিনি নামাজ পড়ছিলেন। আর নিকটেই ফেরেশতা গন তাঁর উট চরাচ্ছিল। তিনি যখন নামাজ সমাপন করে উঠলেন, সাহাবাদ্বয় উনাকে সালাম করে উনার নাম জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, অধমের নাম আবদুল্লাহ (অর্থ আল্লাহ্ পাক উনার বান্দা)। ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম বললেন, আমরাও আল্লাহ্ পাক উনার বান্দা আপনার আসল নামটি শুনতে চাই। তিনি বললেন, ওয়ায়েস।
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম বললেন, অনুগ্রহ করে আপনার হাতখানা দেখাবেন? তিনি হাত বাড়িয়ে দিলে তাতে অবিকল নুরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি কর্তৃক বর্ণিত নিশানা দেখে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম উনার হাতখানা চুম্বন করলেন। তারপর নুরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসীয়তের কথা উল্লেখ করে উনার হাতে নুরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র জুব্বা/ খেরকা অর্পণ করলেন।
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নির্দেশ অনুযায়ী উনার উম্মতের জন্য দোয়ার কথাও বলা হল। এ সব কথা শুনে হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, দেখুন! আপনারা খুব ভাল ভাবে খোঁজ খবর নিয়ে দেখুন, সম্ভবত: এ অন্য লোক হবে। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম বললেন, আমরা খুব ভাল ভাবেই দেখে শুনে নিয়েছি, খোদ নুরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি যে সকল নিশানার কথা বলে গিয়েছেন আপনার সাথে তা হুবহু মিলে গিয়েছে। আমরা সম্পুর্ণ নিশ্চিত যে, আপনিই নুরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সেই পরম প্রিয় উয়ায়েস্ আল-কারনী। এতক্ষণে হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি আগন্তুকদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন।
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম বললেন, আমার নাম হল ওমর ইবনে খাত্তাব আর এ সঙ্গী হলেন নুরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জামাতা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম । উনাদের পরিচয় লাভ করে হযরত ওয়ায়েস কারনী উনাদের সালাম জানিয়ে উভয়ের হস্ত চুম্বন করে বললেন, আপনাদের মত মহামর্যাদাশীল এ হতভাগা গুনাহগারের কাছে তাশরীফ এনেছেন, এ যে আমার পরম সৌভাগ্য। কিন্তু আপনারা যে আমাকে বে-আদব বানিয়ে দিলেন। তারপর তিনি আরো বললেন, নুরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গুনাহগার উম্মতদের মুক্তির দোয়ার জন্য তো আপনারাই অধিক যোগ্য ব্যক্তি। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম বললেন, আমরা তো তা অবশ্যই করছি, কিন্তু আপনিও নুরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ পালন করুন।
পরবর্তীতে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনি এবং উমর ফারূক্ব আলাইহি সালাম উনি জুব্বা মুবারকটি পৌঁছে দিয়ে উনাকে দোআ করার জন্য বললে তিনি কান্না শুরু করেন। জুব্বা মুবারকটি নিয়ে তিনি নির্জনে নিভৃতে চলে যান এবং সেজদায় পড়ে তিনি আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করতে থাকেন। তিনি বলেন, হে আল্লাহ পাক আমি এই জুব্বা মুবারক ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণ করব না, যতক্ষণ না আপনি সকল উম্মতি মুহম্মদি উনাদের ক্ষমা করবেন। হযরত নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি আমাকে এই দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন। গায়েবী আওয়াজ এলো-“আমি অসংখ্য উম্মতি মোহাম্মদকে ক্ষমা ঘোষণা করলাম, এবার আপনি জুব্বা মুবারক গ্রহণ করুন।” হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি দাবী করেন, আমি সকল উম্মতি মুহম্মদির উনার মাফই কামনা করছি। এমতাবস্থায় হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহি সালাম তিনি উক্ত নির্জন স্থানে উপস্থিত হলে উয়ায়েস রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার একাগ্রতায় ব্যাঘাত ঘটে তখন হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব আলাইহিস সালাম প্রত্যক্ষ করলেন, ছিন্ন কম্বল পরিহিত এই দরবেশ উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি কাছে সারা জগতের অমূল্য ধন-সম্পদসমূহ বিদ্যমান। তা দেখে তিনি অভিভূত ও ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়লেন। খেলাফতের প্রতি উনার বিতৃষ্ণা এসে গেল। তিনি বলে উঠলেন, ওহে কে এমন আছে যে একটা রুটির বিনিময়ে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করবে?
ওমর ইবনে খাত্তাব আলাইহিস সালাম এর কাছ থেকে এই ধরনের স্বাগত উক্তি শুনে হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, যে অবুঝ সে-ই তা করবে। যদি সত্যিই মন না চায় তাহলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেই তো হয়, যার মন চায় সে কুড়িয়ে নিবে। এর মধ্যে আবার অদল-বদলের কি প্রয়োজন আছে?
এই কথা বলে হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি নুরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদত্ত লেবাস পরম ভক্তির সাথে অঙ্গে পরিধান করলেন । তিনি বলেন হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহি সালাম! আপনি আমাকে সওয়াল না করলে এই জুব্বা মুবারক ততক্ষণ পর্যন্ত আমি গায়ে দিতাম না, যতক্ষণ না আল্লাহ তায়ালা সমস্ত উম্মতি মুহম্মদী গনকে ক্ষমা ঘোষণা করতেন। অত:পর তিনি বললেন, এই নাদানের প্রার্থনায় আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন কবিলায়ে রাবী ও কবিলায়ে মোজার-এর ছাগ-পশমের সংখ্যাতুল্য উম্মতে সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ক্ষমার ওয়াদা করেছেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি বলেন বিশ্বাসী আল্লাহর দিদার মুবারক খোজ করবে, এবং কেউ তা অন্তর চক্ষু দ্বারা দেখবে , যা চর্ম চক্ষু দ্বারা পাওয়া যাবে না। এবং জ্ঞান হলো আলো বা নূর যা আল্লাহ যাকে খুশি দান করেন। শারীরিকভাবে কাছাকাছি না থাকলেও ফয়েজ তাওয়াজ্জু লাভ হয়। হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি তারই উদাহরণ। যেহেতু তিনি কখনোই নবিজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে চর্মচক্ষু দ্বারা দেখেন নাই কিন্তু তার পরেও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুহব্বত হাসিল করতে পেরেছিলেন।
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম উনি হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে বললেন, জনাব! আমাদের জন্য একটু দোয়া করুন। তিনি জবাব দিলেন, দেখুন! আমার ঈমান তো আন্তরিকতা শূন্য, তবু আমি দোয়া করছি। আর প্রতি ওয়াক্ত নামাযের তাশাহূদেও এ দোয়াই করে থাকি, হে খালিক মালিক আল্লাহ্ পাক! আপনি মু’মিন নর ও নারীকে ক্ষমা করুন। আর জনাব খলিফা! মনে রাখবেন, যদি আপনি ঈমানের সাথে কবরে যেতে পারেন তা হলে দোয়া নিজেই আপনাকে খুঁজে নিবে। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম উনি বললেন, আরো নছীহত করুন। হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি বললেন, জনাব খলিফা! আপনি কি আল্লাহ্ পাক উনাকে চিনেছেন? হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম উনি জবাব দিলেন, হাঁ, নিশ্চয় চিনেছি। হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, যদি চিনে থাকেন তাহলে অন্য আর কাউকে যেন না চিনেন ও জানেন। তবে তাই হবে আপনার জন্য বেশি উত্তম।
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম উনি বললেন, জনাব! আরো কিছু নছীহত করুন।
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি বললেন, আল্লাহ্ তায়ালা উনি কি আপনাকে চিনেন, জানেন?
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম উনি বললেন, তা তো অবশ্যই।
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি বললেন, একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ যদি আপনাকে না চিনেন ও না জানেন, তাহলে তা আপনার জন্য বেশি ভাল কথা।
এরপর হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম বললেন, জনাব! একটু অপেক্ষা করুন, আমি আপনার জন্য কিছু মাল-সামানা নিয়ে আসি। তখন উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি নিজের জামার পকেট থেকে পয়সা বের করে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম উনাকে দেখিয়ে বললেন, উট চড়ানোর মজুরী বাবদ ইহা আমি উপার্জন করেছি। যদি আপনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন যে, এগুলো খরচ করার পরেও আমি বেঁচে থাকব, তাহলে আমার আরো কিছু মাল-সামানার প্রয়োজন দেখা দিবে অর্থাৎ জীবনের এক মুহূর্ত ও বিশ্বাস নেই, তাই মাল সঞ্চয়ের ও প্রশ্ন আসে না। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম থেকে তিনি কিছু গ্রহণ করতে রাজী হলেন না।
অতঃপর হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি সাহাবাদ্বয় উনাদের সম্বোধন করে বললেন, যাহোক, মাননীয় মেহমান দ্বয়! অধমের সন্ধানে এত দূর আসতে বহু কষ্ট পেয়েছেন। তারপর আমিও আপনাদেরকে কম কষ্ট দেইনি। আশা করি অপরাধ ক্ষমা করবেন। তবে এখন আপনারা প্রস্থান গ্রহণ করুন। দেখুন, কিয়ামত খুবই নিকটবর্তী। আল্লাহ্ পাক উনার রহমতে সে সময় আবার সাক্ষাত হবে আশা করি। তখন আমাদের সান্নিধ্য দীর্ঘস্থায়ী হবে। আমি এখন আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহে অধিক ব্যস্ত। এই পর্যন্ত বলে সম্মানিত সাহাবাদ্বয় উনাদের বিদায় প্রদান করে তিনি নিজেও সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন।
অন্তর দিয়ে তিনি হযরত নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খুবই কাছাকাছি ছিলেন যার কারণে তিনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ব্যথা নিজেও অনুধাবন করতে চেয়েছেন। যার ফলে যখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দাঁত মুবারক যুদ্ধে শহীদ হন, তিনিও উনার সমস্ত দাঁত ভেঙে ফেলেন।
উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি পন্থানুযায়ী শারীরিক ভাবে নয় বরং বাতেনী/ অন্তর চক্ষু জ্ঞানের দ্বারাই তিনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দাঁত মুবারক শহীদ হবার বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন। এটা সরাসরি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনা থেকে প্রাপ্ত নেসবত এর সাথে সম্পৃক্ত। বিশ্বাসীগন আল্লাহর নূরকে খুঁজতে থাকে। এটা ততক্ষণ অবধারণ করা যায় না যতক্ষণ অন্তরদ্বারা তা অনুধাবন করা না যায়।
উক্ত সাহাবাদ্বয় উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি সাথে উনার সাক্ষাতের পর থেকেই উনার মান-মর্যাদার কথা লোক সমাজে প্রকাশ হয়ে পড়ে। এর ফলে তাঁর নির্জন ইবাদত বিঘ্নিত হবে অনুধাবন করে তিনি কারণ এলাকা থেকে কুফায়(বর্তমান ইরাক) চলে জান। শুনা যায়, এরপর হারাম ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি ছাড়া আর কারো সাথে উনার সাক্ষাত হয়নি।
হযরত হারাম ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথে মুলাকাত:
হযরত হারাম ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সম্পর্কিত অভূতপূর্ব ঘটনাবলী শুনতে পেয়ে উনার সাথে সাক্ষাত করার জন্য অধীর হয়ে উঠলেন এবং উনাকে খুঁজতে বের হয়ে পড়লেন। অনেক অনুসন্ধানের পর কুফায় উনার সাক্ষাত লাভ করলেন। একদিন তিনি উনাকে ফোরাত নদীতে অজু করতে দেখলেন। হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শারীরিক নিদর্শনগুলোর কথা তিনি পূর্ব থেকেই জানতেন। সেইগুলোর সাথে পুরো পুরি মিল দেখে তিনি উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে চিনে ফেললেন। তিনি উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে সালাম করে মোসাফাহার জন্য হাত বাড়ালেন। হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি সালামের জবাব দিলেন, কিন্তু মোসাফাহ করলেন না।
হযরত ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, আল্লাহ পাক তিনি আপনার প্রতি উনার করুণা বর্ষণ করুন। হযরত ইবনে জাবান উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর দারিদ্যের করুণ অবস্থা দেখে চোখের পানি দমিয়ে রাখতে পারলেন না। তিনি কেঁদে দিলেন। হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও কাঁদলেন।
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, হে হারাম ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি! আল্লাহ্ পাক আনাকে দীর্ঘজীবী করুন, আপনি কি জন্য এখানে এসেছেন? আপনি আমার সন্ধানই বা পেলে কার কাছে?
হযরত ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, জনাব! আপনি আমার পিতার নাম এবং আমার নাম কি করে জানলেন? ইতিপূর্বে তো কখনই আমাকে দেখেন নি। সম্ভবত আমার কথা কখনো কারো কাছে শুনতে ও পাননি।
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, যিনি সর্বজ্ঞ তিনিই আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন। আমার আত্মা তোমার আত্মার সন্ধান নিয়েছে। অতঃপর হযরত ইবনে জাবান উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে আরজ করলেন, জনাব! নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্পর্কে কিছু বলুন।
উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি জবাব দিলেন, আমি উনাকে স্বচক্ষে কখনও দেখিনি। উনার পবিত্র বানীগুলো অন্যের মারফতে শুনেছি মাত্র। তারপর কোন ওয়ায়েজ বা মুহাদ্দিস রূপে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে চাইনি। আমার অন্য কাজ রয়ে গেছে। উনার কথা শুনে হযরত ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, জনাব! আপনি যদি কালামে পাক থেকে কিছু আয়াত তেলাওয়াত করতেন, আমি একটু শুনতাম। হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি তখন পাঠ করলেন—‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বানির রাজীম’ কালামটি পাঠ করে আকুল ভাবে ক্রন্দন শুরু করলেন এবং ক্রন্দনরত অবস্থায়ই কোরআন পাকের আয়াত ‘অমা খালাক্বতুল জ্বিন্না অল ইনসা ইল্লা-লিইয়া’ বুদুন’ তেলাওয়াত করলেন। অর্থাৎ আমি জ্বিন এবং মানব জাতিকে শুধু মাত্র আমার ইবাদতের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি।
এ আয়াত শরীফ পাঠ করেই তিনি এমন জোরে এক চিৎকার করে উঠলেন, মনে হল তিনি বেহুঁশ হয়ে গেছেন। কিন্তু না, তিনি ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে লক্ষ্য করে বললেন, ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি! বলুত আপনি কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন? ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, আপনার প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধাই আমাকে টেনে এনেছে।
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কথা শুনে বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে চিনেছে, সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও সাথে ভালোবাসা করে শান্তি পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। জেনে রাখুন, একমাত্র আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারও সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে কেউ কোন দিন সুখী হতে পারে না। অতঃপর ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, জনাব, আমাকে কিছু উপদেশ দিন।
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি বললেন, ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি! যখন নিদ্রাগমন করবেন, মৃত্যু তখন পনার শিয়রে বলে মনে করবেন
আর জাগ্রতাবস্থায় সর্বদাই মৃত্যুকে আপনার চোখের সামনে বলে মনে করবেন। যে কোন গুনাহকে ছোট মনে করবেন না। কেননা গুনাহকে ছোট মনে করা ও একটি গুনাহ ছাড়া আর কিছু নয়।
এরপর হযরত ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে জানতে চাইলেন ,জনাব, বলুন, আমি এখন কোথায় বসবাস করব?
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি জবাব দিলেন, আপনি সিরিয়ায় চলে যান। হযরত ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, নতুন অপরিচিত দেশে গিয়ে আমার রুজি রোজগার কিভাবে চলবে?
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি বললেন, যার মনে এত ভাবনা চিন্তা তার উপদেশে কোন ফায়দা হবে না।
হযরত ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি আরো কিছু নছীহতের জন্য অনুরোধ করলেন। তখন হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, আপনার পিতা চলে গেছেন। হযরত আদম আলাইহি সালাম উনা থেকে হযরত নূহ আলাইহি সালাম, হযরত মূসা আলাইহি সালাম , হযরত ঈশা আলাইহি সালাম, এমনকি আখেরী নবী প্রিয় নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়া থেকে পর্দা করেছেন, ভাই হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম-ও একই পথের পথিক হয়েছেন। এই পর্যন্ত বলে তিনি হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম বলে ক্রন্দন করতে লাগলেন। ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, আল্লাহ্ আপনার মঙ্গল করুন। কিন্তু জনাব! হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহি সালাম তো মৃত্যুবরণ করেন নি?
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি বললেন, আল্লাহ্ পাক আমাকে উনার মৃত্যুর খবর পৌছিয়ে দিয়েছেন। তারপর তিনি বললেন, তুমি আমি সবাই তো মৃত্যুদেরই দলভুক্ত।
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি নামায আদায় করত: দোয়া করলেন। পরে উপদেশ স্থলে বললেন, জনাব! পবিত্র কোরআন শরীফ এবং অলীদের বানী অনুসরণ করে চলবেন। আর এক পলকের তরেও মৃত্যুর কথা ভুলে থাকবেন না। জনাব! আপনার সাথে আমার আর সাক্ষাত হবে না। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন, আমিও আপনার জন্য দোয়া করছি আপনি খাঁটি মুসলমান গনের মত জীবন যাপন করবেন। এরপর তিনি ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনি এই পথ দিয়ে চলে যান আর আমি অন্য পথ দিয়ে বিদায় নিচ্ছি। হযরত ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথে কিছু দূর অগ্রসর হতে চাইলেন, কিন্তু হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাতে রাজী হলেন না। বিদায় কালে হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি কেঁদে দিলেন এবং ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকেও কাঁদালেন।
হযরত ইবনে জাবান রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথে আমার একবার ই মাত্র দেখা হয়েছিল এবং সেইটাই আমার প্রথম এবং শেষ দেখা।
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার আমল:
এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, অনেক সময় হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি ফজরের নামায আদায় করে তাসবীহ পাঠ করতে করতে জোহরের ওয়াক্ত হয়ে যেত। জোহরের নামায পড়ে তাসবীহ পাঠে আছরের ওয়াক্ত হয়ে যেত। আছরের সালাত আদায় করে মাগরিব পর্যন্ত তাসবীহ পাঠ করতেন। আবার মাগরিব আদায় করে এশা পর্যন্ত তাসবীহ পাঠ করে এশার নামায আদায় করে মুরাকাবা করতেন, তাতে ফজর হয়ে যেত। ফজর থেকে পূর্বানুরূপ সেই একই অবস্থা চলতে থাকত। এই ভাবে একাধারে উনার কয়েক দিন চলে যেত। এর মধ্যে না ছিল উনা পানাহার, না ছিল বিশ্রাম নিদ্রা। তাছাড়া প্রয়োজন দেখা দেয়নি ইস্তেঞ্চা করার। তাই উনার ওযু গোসলের ও দরকার ছিল না।
তিনি একাধারে বহু রাত শয্যাগমন না করে বলতেন, এই রাতটি আমার কিয়ামের জন্য, এই রাতটি রুকুর জন্য, এই রাতটি সিজদাহ্র জন্য। এইভাবে প্রতিটি রাত তিনি বিনিদ্র ইবাদতে কাটিয়ে দিতেন।
লোকজন জিজ্ঞেস করতেন, উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি আপনি কেমন আছেন?
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি বলতেন, কি বলব, সিজদায় গিয়ে সিজদাহ্র তাসবীহ পড়তে না পড়তেই রাত অবসান হয়ে যায়। মনে চায় একটু ফেরেশতাদিগের মত ইবাদত করি, কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না।
আর একবার তিনি ‘কেমন আছেন’ প্রশ্নের উত্তরে বললেন, কেমন আছি তা কি করে বলব? যে ব্যক্তি প্রত্যুষে উঠে সন্ধ্যার পূর্বেই তার মৃত্যুর আহ্বান আসে কিনা বলেতে পারে না, সে আবার কেমন থাকবে?
প্রশ্নকারী বললেন, তবু বলুন, আপনার অবস্থা কি?
তিনি বললেন, এক নিঃসম্বল ও পাথেয় শূন্য পথিক! তার পথ যে খুবই দীর্ঘ।
একদিন এক ব্যক্তি উনাকে জিজ্ঞেস করল, হুযুরী কালবের (আন্তরিক একাগ্রতা) নামায কিরূপ?
তিনি জবাব দিলেন, যে নামায নামাযী তীর বিদ্ধ হলেও টের পায় না, তাকেই বলে হুযুরী কালবের নামায।
একবার কোন এক ব্যক্তি উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে উনার করুন অবস্থা দেখে একটি দামি কাপড় হাদিয়া করেন। কিন্তু উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি তা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, “ওহে মানুষ আমাকে এই বস্ত্র পরিধান করতে দেখলে চোর বলে সন্দেহ করবে।“
উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উট চরিয়ে অতি অল্প আয় করতেন। যখন তিনি মনে করতেন এই আয় উনার মার খিদমতের জন্য যথেষ্ট হবে তখন আয় করা থামিয়ে দিতেন। আর উনার মায়ের খিদমত করার পর যা বেচে যেত তা দরিদ্র ও ঋণ গ্রস্থ প্রতিবেশী গনদের দান করে দিতেন।
একবার লোকজন হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর কাছে একটি লোকের একটি আশ্চর্য খবর নিয়ে এলো। লোকটি দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে একটি কবরস্থানে বসে গলায় কাফনের কাপড় ঝুলিয়ে শুধু ক্রন্দন করছে। তার অন্য কোন কাজ নেই।
এ খবর শুনে হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি বললেন, তোমরা আমাকে তার কাছে নিয়ে চল। সেখানে উপস্থিত হয়ে তিনি দেখলেন, সত্যিই লোকটি এতদিন ধরে কেঁদে কেঁদে একেবারে জীর্ণ ও কঙ্কাল হয়ে গেছে। তার খানা পিনা আরাম নিদ্রা কিছুই ছিল না।
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি লোকটিকে বললেন, ওয়ে গাফেল! কবর ও কাফনের কাপড় যে তোমাকে আল্লাহ্র নিকট থেকে বহু দূরে নিয়ে গেছে। ঐ দুটো বস্তু তোমাকে খাঁটি পথ ভুলিয়ে দিয়ে বিপথগামী করেছে। শীঘ্র উঠে পড় এবং আল্লাহ্র পথ অবলম্বন কর। হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর ধমকে লোকটির হুঁশ ফিরে আসল এবং তওবা করে নামায রোযা শুরু করে দিল।
কথিত আছে, একবার হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি একাধারে তিন দিন পর্যন্ত অনাহারী থেকে চতুর্থ দিন ক্ষুধার প্রবল তাড়নায় বের হয়ে পড়লেন, দেখা যাক আল্লাহ্ তা’আলা খাবার কোন কিছু মিলিয়ে দেন কিনা। হঠাৎ পথে পড়ে থাকা একটি দিনার তাঁর চোখে পড়ল। তিনি ভাবলেন, হয়তো এ কারো হারানো দিনার, তাই তিনি গ্রহণ না করে অগ্রসর হলেন। মনে মনে ভাবলেন, কিছু কচি ঘাঁস চিবিয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করবেন। ঠিক এমন সময় কোথা থেকে একখানা গরম রুটি তার সামনে রেখে দিল। হয়তবা রুটিখানা অন্য কোন ব্যক্তির হতে পারে এই ভেবে তিনি তাও এড়িয়ে গেলেন। তখন একটি ছাগ তাকে বলল, এই রুটি আপনারই। দেখুন! আপনি যার বান্দা, আমিও তাঁর এক দাস। ছাগের ইঙ্গিত লাভ করে ও এমন কথা শুনে হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি রুটিখানা তুলে নিলেন। অমনি ছাগটি চোখের নিমিষে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি দীর্ঘ জীবন লাভ করে অবশেষে জান্নাত বাসী হন। অনেকের মতে তিনি বার্দ্ধক্যে সিফফিনের যুদ্ধে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনার পক্ষে যোগদান করে শেষ পর্যন্ত ৬৫৭হিজরী শনে শাহাদাত বরন করেন।
উনার রওজা নিয়ে কিছু মত পার্থক্য রয়েছে তবে বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বাতুতা হযরত উয়ায়েস্ আল-কারনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সমাধি সিরিয়ার আর-রাক্বাহ নামক স্থানে উল্লেখ করেন, যেখানে তিনি সিফ্ফিনের যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেন।
(সংগৃহীত)